চিকুনগুনিয়া আউটব্রেক (২০১৭) নিয়ে একটি কম্প্রিহেনসিভ রিসার্চ পেপার
Posted on: August 8, 2018, by : Mahbub Hasanবহুল আলোচিত চিকুনগুনিয়া (২০১৭) নিয়ে গবেষণার বিস্তারিত ফলাফল বিখ্যাত জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
২০১৭ সালের বহুল আলোচিত চিকুনগুনিয়া আউটব্রেক নিয়ে একটি কম্প্রিহেনসিভ রিসার্চ পেপার অতি সম্প্রতি একটি বিখ্যাত জার্নালে (PLos Neglected Tropical Diseases) প্রকাশিত হয়েছে। এতে বিশদভাবে চিকুনগুনিয়ার বিভিন্ন উপসর্গ, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় খরচ এবং আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনযাত্রায় এর প্রভাব কেমন তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গত বছর এই সময়ে (জুন, ২০১৭) ঢাকা নগরীতে ভয়াবহ চিকুনগুনিয়া আউটব্রেক ছড়িয়ে পড়েছিল। পত্র- পত্রিকায়, রাস্তা-ঘাটে, অফিস-আদালতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- সব জায়গাতে আলোচনার বিষয় ছিল চিকুনগুনিয়া। নগরীর হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলো ছিল রোগীতে পরিপূর্ণ।
এ রোগে আক্রান্ত হলে পুরো শরীরের জয়েন্টসমূহে অসহ্য ব্যথার সাথে প্রচন্ড জ্বর হয়। যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে যায়। এজন্য এ রোগকে “ল্যাংডা জ্বর” হিসেবে অভিহিত করা হয়।
এর আগে বাংলাদেশে বড় স্কেলে চিকুনগুনিয়া আউটব্রেক হয়নি। রোগটির ক্লিনিক্যাল লক্ষণ এবং সার্বিক ব্যবস্থাপত্র সম্পর্কে অপরিচিত থাকার কারণে জনমনে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। আইইডিসিআর এর তথ্য অনুযায়ী ঢাকার তিনটি পাবলিক হাসপাতালে ১২০৬০ জন রোগী স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছে। কিন্ত বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী দেশের প্রায় ৭০ ভাগ লোক প্রাইভেট স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকে এবংঢাকা শহরে প্রায় ২০০০টি নিবন্ধিত ক্লিনিক/হাসপাতাল রয়েছে। এসব কিছু বিবেচনায় নিলে ২০১৭ সালের আউটব্রেকটি সম্ভবত অনেক বড় স্কেলে হয়েছিল।
এহেন পরিস্থিতিতে বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউণ্ডেশন (বিআরএফ), একটি ঢাকা ভিত্তিক কলাবোরেটিভ রিসার্চ প্লাটফর্ম, এর উদ্যোগে ১১১ জনের একটি স্বেচ্ছাসেবী রিসার্চ টিম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে উক্ত গবেষণাকাজটি সম্পাদন করে। এই টিম গঠনে এবং স্টাডি মনিটরিং করতে ফেসবুক গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। ফেসবুক প্লাটফর্মে উন্মুক্ত আহবানে সাড়া দিয়ে দেশের ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়সহ মোট ৩৪টি প্রতিষ্ঠান থেকে স্বেচ্ছাসেবী রিসার্চাররা অংশগ্রহণ করেন। বড় কোন আউটব্রেকের সময় স্বেচ্ছাসেবী টিমের মাধ্যমে কাজ করার দৃষ্টান্ত পাবলিক হেলথ রিসার্চ ফিল্ডে সম্ভবত নজির নেই। প্রজেক্টটি শুরু হয়েছিল চিকুনগুনিয়ায় তীব্রভাবে আক্রান্ত একজন হেলথ রিসার্চারের আহবানে।
দুটি সায়েন্টিফিক প্রশ্নের উত্তর জানতে প্রজেক্টটি ডিজাইন করা হয়-
১) চিকুনগুনিয়ার লক্ষণসমূহের তীব্রতার সাথে জীবনযাত্রার মানের প্রভাব কেমন এবং
২) চিকিৎসা বাবত রোগীর খরচ পারিপারিক-অর্থনৈতিক অবস্থার উপর কেমন প্রভাব ফেলেছে।
চিকুনগুনিয়া আক্রান্তের প্রথম দুই সপ্তাহে রোগীর অভিজ্ঞতার আলোকে স্টাডির ডেটা সংগ্রহ করা হয়েছিল। তবে এক্ষেত্রে, চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব কেমন ছিল (অর্থাৎ কতজন আক্রান্ত হয়েছে) তা এই স্টাডির মাধ্যমে জানা যাবে না।
রিসার্চার পেপারের উল্লেখযোগ্য অংশটুকু দেয়া হলো। বিস্তারিত জানতে লিংকে জার্নালের আর্টিকেল দেখুন, লিংক নিচে দেয়া আছে।
১। চিকুনগুনিয়ার ক্লিনিক্যাল প্রোফাইল সংক্রান্ত এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্টাডি যেখানে ১৩২৬ জন রোগীর লক্ষণসমূহ এনালাইসিস করা হয়েছে।
২। বাংলাদেশের চিকুনগুনিয়া রোগের তীব্রতা বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় খুব আলোচিত আউটব্রেকের (ফ্রান্স শাসিত ভারত মহাসাগরে দ্বীপ লা রিইউনিয়ন আইল্যান্ড) সমপর্যায়ে অথবা ক্ষেত্র বিশেষে তীব্রতার মাত্রা বেশী ছিল যা স্টাডিতে উঠে এসেছে।
৩। চিকুনগুনিয়ার অন্যতম লক্ষণ হল জ্বর, অস্থি:সন্ধি তথা গিড়ায় ব্যাথা, স্কিন ড়্যাশ, মাংসপেশীর ব্যাথা, মাথাব্যাথা, চুলকানী এবং শরীর ফুলে যাওয়া। চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত হলে সাধারণত জ্বর দিয়ে লক্ষণ শুরু হয়, অতঃপর অন্যান্য লক্ষণগুলো আসে।
তবে, আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে প্রায় ৭৫ ভাগ রোগীর সমস্যা শুরু হয়েছে জ্বরের আগে গিড়া ব্যাথা দিয়ে। বাংলাদেশের চিকুনগুনিয়ার এই লক্ষণটি ইউনিক (Novel finding) যার মাধ্যমে ডেংগু এবং চিকুনগুনিয়াকে চিকিতসকরা আলাদা করতে সক্ষম হতে পারেন। এর আগে এই লক্ষণটি সায়েন্টিফিক্যালি জোড়ালোভাবে রিপোর্ট হয়নি।
৪। আমাদের গবেষণায়, ব্যাথার তীব্রতা পরিমাপ করতে নিউমেরিক্যাল পেইন রেটিং-স্কেল নামক একটি স্বীকৃত পরিমাপক ব্যবহার করা হয়েছে। এই স্কেল অনুযায়ী রোগীকে ব্যাথার তীব্রতা অনুপাতে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত যে কোন একটি নাম্বার দিতে বলা হয়। ব্যাথার তীব্রতা কম হলে ১ এবং ব্যতার তীব্রতা বেশী হলে ১০। এই স্কেল অনুসারে আমাদের গবেষণায় রোগীদের গড় ব্যাথার তীব্রতা ছিলো ৮.৩ যা কিনা তীব্র মাত্রার অন্তর্গত।
৫। প্রায় ৫৬% রোগীর চার এর অধিক গিড়া আক্রান্ত পাওয়া গিয়েছে এবং প্রায় ৪০% রোগীর ক্ষেত্রে আক্রান্ত গিড়ার সংখ্যা ছিলো দুই থেকে চারটি। দেহের বিভিন্ন গিড়ার মধ্যে পায়ের গোড়ালী এবং হাতের কবজির সন্ধি আক্রান্ত হয়েছিলো সবচেয়ে বেশী।
৬। ব্যাথার জন্য প্রায় ৭০% রোগীর দৈনন্দিন কাজে ব্যঘাত ঘটে এবং প্রায় ৬৬ শতাংশ রোগীর ঘুমে ব্যঘাত ঘটে।
৭। আমাদের গবেষণায় বয়স, লিঙ্গ এবং পূর্বাপর শারিরীক অবস্থার উপর ভিত্তি করে রোগের লক্ষণের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। পনের বছরের নিচের বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দুই থেকে চারটি গিড়ায় ব্যাথা এবং স্কিন ড়্যাশ বেশী দেখা যায়। অন্যদিকে ষাটোর্ধ্ব রোগীদের ক্ষেত্রে গিড়া ফুলে যাওয়া ছিলো অন্যতম প্রধান লক্ষণ। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ব্যথার তীব্রতা অভিযোগ ছিল সবচেয়ে বেশী।
৮। এ গবেষণা দেখা গেছে চিকুনগুনিয়ার কারণে ৯৫% রোগী সম্পূর্ণভাবে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছে। মোট আক্রান্ত রোগীর ৬৫ ভাগ ৭-১০ দিন পর্যন্ত ঘরে এবং বাইরের (যেমন অফিস, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়) কোন কাজ করতে পারেননি । বাকী ৩০ ভাগ রোগী কমপক্ষে ১০ দিনের বেশী কোন কাজই ঠিক মত করতে পারেন নি।
৯। এ মহামারীতে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশী চাপে ছিলো তারা যাদের মাসিক আয় ২৫০০০ টাকার কম ছিল। এমন কি দীর্ঘদিন কাজে অনুপস্থিত থাকার কারণে কারও কারও ক্ষেত্রে চাকুরী চলে যাওয়ার ঘটনাও পাওয়া গেছে।
১০। বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত ও বহুল ব্যবহৃত প্রশ্নমালা দিয়ে জীবনযাত্রার মান (কোয়ালিটিফ অফ লাইফ) যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেছে যাদের বয়স ৬০-এর বেশী, যাদের মাসিক আয় ৫০০০০ টাকার বেশী, চাকুরীজীবি এবং ব্যবসায়ীদের জীবনযাত্রার মান অন্যদের তুলনায় বেশী কমে গিয়েছিলো।
এ গবেষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চিকুনগুনিয়ার প্রধান লক্ষণগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে এবং জীবনযাত্রার উপর এর প্রভাব নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক স্টাডি করা হয়েছে। আমরা আশা করছি এই গবেষণা জাতীয় পর্যায়ে চিকুনগুনিয়া রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধে নীতিনির্ধারনে সহায়ক হবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দালিলীক অবদান হিসেবে থেকে যাবে।
মূল গবেষণাপত্রের ঠিকানা:
http://journals.plos.org/plosntds/article?id=10.1371/journal.pntd.0006561